বন্দরবাসী এই নারকীয় দৃশ্যের পরিবর্তন চায়
শীতলক্ষ্যায় বেপরোয়া গতিতে চলে বাল্কহেড
বাংলাবাজার বার্তা ডেস্ক :
প্রকাশ: ২৩:৫৮, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | আপডেট: ০০:০৭, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

দৈনিক অন্তত পাঁচ/ছয়টি নৌকা কিবা যাত্রী পারপারের বড় ট্রলার মালবাহী কিম্বা খালি বাল্কহেড এর ধাক্কা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যায়। এটা আল্লাহর অশেষ রহমত। শনিবার বিকেলেও বাল্কহেড এর ধাক্কায় ৯ জন যাত্রী নিয়ে নবীগঞ্জ এলাকায় নৌকা ডুবে যায়। আশপাশের লোকজন দ্রুত ছুটে এসে সকল যাত্রীকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন।বন্দরবাসী এই নারকীয় দৃশ্যের পরিবর্তন চায়। কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে নিরব। শীতলক্ষা নদীতে বেপরোয়া গতিতে চলাচল করে বাল্কহেড ও ছোট জাহাজ। বেপরোয়া গতি। রাতের বেলায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থাও থাকেনা। প্রতিবছর বন্দর, নবীগঞ্জ, ২নং ঢাকেশ^রীসহ বিভিন্ন ঘাটে বাল্কহেড এর ধাক্কায় নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। এতে কমপক্ষে ৮/৯ জনের মৃত্যু ঘটে।
বাল্কহেড। নৌকাডুবি। কিম্বা একটুর জন্য নৌকাডুবি থেকে রক্ষা পাওয়া নিয়মিত ব্যাপার। শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড়ের বাসিন্দাদের কাছে। বন্দরের আবাল বৃদ্ধ ভনিতা-এই পরিস্থিতির সাথে অভ্যস্থ।
বর্ষাকাল ছাড়াই শীতলক্ষ্যা নদীতে নৌ চলাচল বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফিটনেসবিহীন লঞ্চ, অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অদক্ষ চালক এবং কার্গো জাহাজের বেপরোয়া চলাচল ও যত্রতত্র নোঙর করে রাখায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌপথ।
বন্দরের লাখো যাত্রীদের অভিযোগ, দীর্ঘদিনের পুরনো জরাজীর্ণ লঞ্চ ও বাল্কহেড এর বেশির ভাগেরই ফিটনেস নেই। ফলে প্রায়ই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। যাত্রীদের জীবন ঝুঁকিতে থাকলেও প্রশাসন নীরব ভূমিকা এখন নৌযানই যদি নকশাজনিত ত্রুটিপূর্ণ থাকে, তাহলে নিরাপত্তাঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।
এমন নৌযান অহরহ চলাচল করছে নারায়ণগঞ্জ থেকে অন্যান্য জেলা পর্যন্ত ছয়টি নৌপথে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েও কাজ হয়নি। লঞ্চ মালিকেরাও যে শর্তে এসব লঞ্চ চালানোর অনুমতি পেয়েছিলেন, তা মানেননি। মাত্র দু’তিনটি হাইডেক এর লঞ্চ নামানো হয়েছে নারায়ণগঞ্জে। কিছুদিন সি ট্রাক চলাচল করে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে নারায়ণগঞ্জের নৌপথগুলোয় যেকোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
জানাগেছে, নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর সদর, মতলব, রামচন্দ্রপুর, নড়িয়া, মুন্সিগঞ্জসহ মোট ছয়টি নৌপথে আগে ৩৫টি লঞ্চ চলাচল করতো। এর মধ্যে ৩২টিই হচ্ছে সানকিন ডেক লঞ্চ। এ লঞ্চগুলোর ডেক পানিতে নিমজ্জিত থাকে। বড় ঢেউয়ের আঘাতে এসব লঞ্চ স্থির থাকতে পারে না এবং বড় কোনো নৌযানের ধাক্কায় সহজেই কাত হয়ে ডুবে যায়। ফলে নিরাপত্তাঝুঁকি থাকায় এসব লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
এক মাস বন্ধ রাখার পর মালিকদের আবেদনে এক বছরের মধ্যে সানকিন ডেক থেকে হাইডেকে রূপান্তরের শর্তে ওই লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দেয় বিআইডব্লিউটিএ। তবে গত দুই বছরেও সেই শর্ত বাস্তবায়ন করেননি লঞ্চের মালিকেরা এবং ঝুঁকি নিয়েই পুরনো সানকিন ডেক লঞ্চগুলো চালাচ্ছেন তাঁরা। অথচ গত তিন বছরে সানকিন ডেক লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৪৪ জন যাত্রীর প্রাণহানি ঘটেছে।
বিআইডব্লিউটিএর বক্তব্য, তারাও চায় ঝুঁকিপূর্ণ সানকিন ডেক লঞ্চ ও বাল্কহেড চলাচল বন্ধ হোক। এ ক্ষেত্রে মালিকদের এগিয়ে আসতে হবে। তবে নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় নাগরিক সমাজের অভিযোগ, দুর্ঘটনায় এত মানুষের প্রাণহানির পরও বিআইডব্লিউটিএর আশকারায় এসব লঞ্চ এখনো চলাচল করছে। অর্থের বিনিময়ে বাল্কহেড ও লঞ্চ মালিকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করার অভিযোগও করছেন তাঁরা বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
তবে লঞ্চ ও বাল্কহেড মালিকদের বক্তব্য, আগের মতো সানকিন ডেক লঞ্চের নকশা অনুমোদন করা হচ্ছে না। ফলে এ ধরনের লঞ্চের সংখ্যা কমে আসছে। এ ছাড়া সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা প্রসারের কারণে নৌপথে যাত্রীও কমে গেছে। এ কারণে অনেকে নতুন করে বিনিয়োগ করে সানকিন ডেককে হাইডেকে রূপান্তর করতে চাইছেন না।
বোদ্ধামহল মনে করেন নারায়ণগঞ্জের এসব নৌপথ এখনো বেশ জনপ্রিয়। নিরাপদ নৌযান চলাচল নিশ্চিত করাসহ যাত্রীসেবা ও সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা দরকার। এসব নৌপথের যাত্রীরা আরও বেশি আকৃষ্ট হবেন। লঞ্চমালিকেরা বিনিয়োগ করতেও দ্বিধা করবেন না। কিন্তু কোনো অজুহাতে সানকিন ডেক লঞ্চ চলাচলের সুযোগ নেই। বিআইডব্লিউটিএকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় তাদের ওপরেই বর্তাবে।
যাত্রীদের জীবন ঝুঁকিতে থাকলেও প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে। নৌপথে শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তারাও প্রভাবশালী নৌযান মালিকদের কাছে অসহায়। বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়েই এ পথে চলাচল করতে হচ্ছে যাত্রীদের। বিআইডব্লিউটিএ ও নারায়ণগঞ্জ-মুন্সিগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনাল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরির সুবাদে বন্দর থেকে প্রতিদিন শীতলক্ষ্যা নদী পার হয় লাখো মানুষ। মুন্সিগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩৫ হাজার মানুষ নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় যাতায়াত করে। সড়কপথে যানজটের ভোগান্তি এড়াতে নদীপথে লঞ্চে মুন্সিগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে রাজধানীতে যাতায়াত করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে এ অঞ্চলের মানুষ।
স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী, জোড়াতালি দিয়ে বছরের পর বছর চলছে এ রুটে বাল্কহেড ও লঞ্চ। এসব লঞ্চে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছে যাত্রীরা। তবে স্বল্প দূরত্বের গুরুত্বপূর্ণ এ নৌপথে যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে দীর্ঘদিনেও উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। আর বাল্কহেডগুলো দৈত্যের মত পারপারের নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে চলে যায়।
সূত্রমতে, ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল এসকেএল-৩ নামের একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় সাবিত আল হাসান নামের একটি লঞ্চ ডুবে সলিল সমাধি হয় ৩৬ জনের। বছর না ঘুরতেই ২০২২ সালের ২০ মার্চ আরেকটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবে ১০ জনের মৃত্যু হয়। এরপর দুর্ঘটনা এড়াতে এ নৌরুটে অনির্দিষ্টকালের জন্য লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটএ)। সে সময় নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, নিরাপদ নতুন নৌযান সংযুক্ত করে নৌপথটি পুনরায় সচল করা হবে। কিন্তু কয়েকদিন বন্ধ থাকার পর পুরনো লঞ্চগুলোকেই চলাচলের জন্য ফের অনুমতি দেয় কর্তৃপক্ষ। এতে ঝুঁকিপূর্ণ নৌপথটি পরিণত হয়েছে মরণফাঁদে।
ফরহাদ মিয়া নামের এক যাত্রী বলেন, ‘আমাকে প্রতিদিনই ব্যবসার কাজে মুন্সিগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জের বন্দরে যেতে হয়। সড়কপথে দীর্ঘ পথ ঘুরে যাওয়াসহ যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব একটা ভালো না হওয়ায় ভোগান্তি এড়াতে লঞ্চে করেই কর্মস্থল থেকে যাতায়াত করি। কিন্তু এসব ফিটনেসবিহীন লঞ্চের কারণে প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনটা ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
তবে লঞ্চ চালক ও মালিকরা বলছেন, অবৈধভাবে নদীতে নোঙর করে রাখা ও বেপরোয়া গতিতে চলাচল করা বিভিন্ন কার্গো জাহাজের জন্য সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়তে হচ্ছে নৌকা ও লঞ্চচালকসহ যাত্রীদের। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেড়েছে। তারা নদীতে যত্রতত্র নোঙর করে রাখা কার্গো জাহাজের বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নেয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে দাবি জানান।