আড়াইহাজারে বিএনপি নেতাকর্মীরা দোকান ভাড়া নিয়ে দলীয় অফিস খুলেছে

ভাড়া চাওয়ায় মালিককে পিটিয়ে হত্যা

আড়াইহাজার প্রতিনিধি:

প্রকাশ: ২৩:২৪, ৩০ জুলাই ২০২৫

ভাড়া চাওয়ায় মালিককে পিটিয়ে হত্যা

‘চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও খুন-খারাবিতে বিএনপি ফ্যাসিস্ট সরকারের সন্ত্রাসীদেরকেও ছাড়িয়ে যাবে। জেলাজুড়ে নৈরাজ্য চলছে। প্রতিদিন দখলবাজি ও রক্ত ঝরছে। কেন্দ্রীয় নেতা মাহমুদুর রহমান সুমনের লোকজন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আমরা তাঁর মত কেন্দ্রীয় নেতা আড়াইহাজারের মাটিতে দেখতে চাইনা।’ এমন মন্তব্য আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপি’র প্রবীণ নেতাকর্মীদের। দোকান ভাড়া পরিশোধ না করে উল্টো দোকান মালিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় বিএনপি নেতা সুমনের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি’র নেতাকর্মীরা তীব্র ঘৃণা ও নিন্দা প্রকাশ করে তার গ্রেফতার দাবি জানিয়েছে।

একটি দোকানঘর দখল করে বিএনপির দলীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহারের পর দলটির নেতাদের কাছে ভাড়া চাওয়ায় মালিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাটি গতকাল  বুধবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আড়াইহাজার উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়নের সালমদী বাজারে এ ঘটনা ঘটে। আড়াইহাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার নাসির উদ্দিন গণমাধ্যমকে পিটিয়ে হত্যার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। নিহত মো. জাহাঙ্গীর হোসেন (৫৭) সালমদী নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন।

নিহত জাহাঙ্গীর হোসেন এর ছেলে মো. রাসেল গণমাধ্যমকর্মীদেরকে বলেন, 'গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের কয়েকদিন পর পাশাপাশি তিনটি দোকান একত্রিত করে স্থানীয় বিএনপির কার্যালয় হিসেবে গড়ে তোলেন মাহমুদপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি ও মাহমুদপুর ইউপির ৭ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য তোতা মিয়া প্রধান। কার্যালয়টিতে মাহমুদপুর ইউনিয়ন ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির কার্যালয়ের ব্যানারও সাঁটানো হয়।' 'আমাদের কিছু না জানিয়ে এখানে তারা পার্টি অফিস বানায়। পাশাপাশি বাকি দুটো দোকান আমার চাচাদের। চাচাদের ভাড়া দিলেও আমাদের কোনো ভাড়া দিচ্ছিলেন না তারা। এ নিয়ে আমরা তাদের সঙ্গে বসলেও কোনো ভাড়া পাইনি। আজ আব্বু ভাড়া চাইতে গেলে তাকে পার্টি অফিসের ভেতরেই মারধর করে।'

প্রাথমিক তদন্তের বরাতে আড়াইহাজার থানার ওসি নাসির উদ্দিন বলেন, 'নিহত জাহাঙ্গীর দোকানটির মালিক ছিলেন। কয়েকমাস আগে স্থানীয় বিএনপি নেতারা সেখানে দলীয় কার্যালয় গড়ে তোলেন। দোকানের ভাড়া চাওয়াকে কেন্দ্র করেই তর্ক-বিতর্ক হয় এবং এক পর্যায়ে বিএনপির ওই কার্যালয়ের ভেতরেই দোকান মালিককে মারধর করা হয়।' পরে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ওসি জানান, 'পুলিশ হাসপাতালে যাওয়ার পর বিষয়টি জেনেছে। এ ঘটনায় ওই এলাকার বিএনপি নেতা তোতা মিয়া প্রধান, তার ছেলে-ভাতিজা ও অনুসারী নেতাকর্মীর জড়িত থাকার অভিযোগ আমরা পেয়েছি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ।'

আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক আশরাফুল আমীন বলেন, 'তাকে নিয়ে আসার আগেই তিনি মারা গেছেন। তার মাথায় আঘাতের গভীর ক্ষত দেখা গেছে।'

যোগাযোগ করা হলে তোতা মিয়ার ছেলে খোকন প্রধান টেলিফোনে গণমাধ্যমকে বলেন, 'জাহাঙ্গীর আমাদের পার্টি অফিসের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। আজ এ নিয়ে তর্কের সময় তোতা প্রধান তাকে (জাহাঙ্গীর) একটি থাপ্পর দেয়। জাহাঙ্গীরও তোতা প্রধানের গায়ে হাত তোলেন। সেখানে আরও মানুষ ছিলেন। পরে হাতাহাতির সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।'

নিজেকে বিএনপিকর্মী পরিচয় দিয়ে খোকন আরও বলেন, 'আমরা তার দোকানের অংশটি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আজ এসে খুব হট্টগোল করেন। তাকে মারধর করা হয়নি, হাতাহাতির সময় আঘাতে মারা গেছেন।'

নিহত মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মাহমুদপুর ইউনিয়ন মৎসজীবী দলের সহসাধারণ সম্পাদক ছিলেন বলে জানা গেছে। মৎসজীবী দলের ওই ইউনিয়ন শাখার সভাপতি মো. নজরুল ইসলাম এ তথ্য জানিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে তাদের ইউনিয়ন মৎসজীবী দলের কমিটির সদস্যদের একটি তালিকা পাঠান।

তালিকায় দেখা গেছে, গত ৪ মার্চ সংগঠনটির আড়াইহাজার উপজেলা শাখার অনুমোদন পাওয়া ওই কমিটির ১৩ নম্বরে রয়েছে জাহাঙ্গীরের নাম। তার নামের পাশে সহ-সাধারণ সম্পাদক লেখা রয়েছে।

জাহাঙ্গীরের ছেলে মো. রাসেলের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বাবার কোনো রাজনৈতিক পদ আছে বলে আমি শুনিনি। তিনি রাজনীতি করতেন না। কেউ ডাকলে যেতেন। তিনি আগে মুদির দোকান চালাতেন। যেখানে এখন বিএনপির অফিস সেখানেই মুদি দোকানটি চালাতেন।'

এ বিষয়ে মাহমুদপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মাসুম শিকারি সংবাদকর্মীদেকে বলেন, 'আমাদের ইউনিয়ন বিএনপির অফিস বাজারের প্রবেশমুখেই। তোতা প্রধান বাড়ির সামনে আরেকটা অফিস খুলেছেন। তিনি মূলত বিএনপির সহ-অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সুমনের ঘনিষ্ঠ অনুসারী। সুমন ও তাদের ঘনিষ্ঠ অনুসারীরাই ওই অফিসে যাতায়াত করতেন। স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপিতে চারটি ভাগ রয়েছে। একটি অংশের নেতৃত্ব দেন মাহমুদুর রহমান সুমন। তার বাড়িও এ উপজেলায়।

জানতে চাইলে আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপির সভাপতি ইউসুফ আলী ভূঁইয়া বলেন, 'আমি নিজে নিহতের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি। তারপর জেনেছি, বিএনপির নামে একটি কার্যালয় করা হয়েছিল, যেটার ভাড়া না দিয়ে ঘুরাচ্ছিল। পরে লোকটাকে আজ মারধর করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনার খুবই ন্যক্কারজনক।'

'ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত বলে অভিযোগ পাচ্ছি, সেই তোতা মেম্বার ও তার পরিবারের লোকজন বিএনপির কোনো পদে নাই। তোতা নিজে সাবেক সভাপতি। কিন্তু আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত  চাই এবং হত্যাকারী যেই হোক না কেন জড়িত সবার আইনের মাধ্যমে বিচার চাই,' বলেন তিনি।

মাত্র ১০ হাজার টাকা বকেয়া দোকান ভাড়া চাওয়ায় এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে বিএনপির মাহমুদুর রহমান সুমনপন্থি গ্রুপের নেতাকর্মীরা।  নিহত জাহাঙ্গীর হোসেন সালমদী বাজারে একটি মুদির দোকান পরিচালনা করতেন। এছাড়াও বাজারে তার মালিকানাধীন আরও তিনটি দোকান রয়েছে। এ দোকানগুলোর মধ্যে তিনটি বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছিল।

ঘটনার পর থেকে অভিযুক্ত তোতা মেম্বার ও তার অনুসারীরা আত্মগোপনে চলে গেছেন।

সম্পর্কিত বিষয়:

আরও পড়ুন