ডাবল মার্ডার কাঁপিয়ে দিল বন্দর উপজেলা
বাংলাবাজার বার্তা ডেস্ক :
প্রকাশ: ২৩:৪১, ২২ জুন ২০২৫

বন্দর উপজেলার রেললাইন সংলগ্ন একটি অটোরিক্সা স্ট্যান্ড। দিনে শত শত অটোরিক্সার আনাগোনা। প্রতিটি গাড়ি থেকে গুনে গুনে ওঠে টাকা। দিন শেষে তা পরিণত হয় লাখ টাকার ‘টোল ঘর’-এ। এই স্ট্যান্ডটিকে কেন্দ্র করেই শনিবার রাতে নারায়ণগঞ্জে ঘটে গেল নৃশংস ডাবল মার্ডার। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে ওঠা ‘টাকার খনি’র এই নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার লড়াইয়ে এবার প্রাণ গেল দুই জনের।
নিহতরা হলেন—বন্দর উপজেলার হাফেজীবাগ এলাকার প্রয়াত সাদেক আলীর ছেলে আব্দুল কুদ্দুস (৭০) ও শাহী মসজিদ এলাকার প্রয়াত আব্দুল জলিল মুন্সির ছেলে মেহেদী হাসান (৪২)। নিহত দু’জনই বিএনপির স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক কাউন্সিলর আবুল কাউসারের অনুসারী রনি-জাফর গ্রুপ এবং সাবেক কাউন্সিলর ও বহিষ্কৃত নেতা হান্নান সরকারের অনুসারী বাবু-মেহেদী গ্রুপের মধ্যে গত কয়েকদিন ধরে ওই স্ট্যান্ড দখল নিয়ে উত্তেজনা চলছিল। শুক্রবার সংঘর্ষ হয়, তাতে রক্ত ঝরেনি। কিন্তু শনিবার রাতে রক্ত ঝরল, জীবন ঝরল।
শনিবার রাত ৯টার কিছু পর। শাহী মসজিদ এবং সিরাজদৌলা ক্লাব মাঠ এলাকায় দুটি আলাদা হামলার ঘটনা ঘটে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জাফর পক্ষের কর্মী পারভেজের বাবা আব্দুল কুদ্দুসকে দোকান থেকে ডেকে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ফেলে রাখা হয়। প্রায় একই সময়ে সিরাজদৌলা ক্লাব মাঠ এলাকায় অপর পক্ষের মেহেদী হাসানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলাকারীরা পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালায়। তাদের হাতে দেশীয় অস্ত্র ছিল। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুজনের মৃত্যু হয়ে যায়।
স্থানীয় রাজনীতিতে প্রশ্ন উঠেছে—এই দ্বন্দ্ব কি শুধুই অটোরিক্সার স্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ, নাকি এর পেছনে আছে বড় কোনো অপরাধচক্রের অর্থনৈতিক স্বার্থ? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবীণ বিএনপি নেতা বলেন, “আগে নেতারা ভোটের জন্য মাঠে নামত, এখন স্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রণের জন্য নামে। প্রতিদিনের চাঁদা ৪০-৫০ হাজার টাকা। মাসে ১০-১৫ লাখ টাকা। এই টাকা ভাগাভাগি নিয়েই রক্তপাত।”
শুধু বন্দর নয়, নারায়ণগঞ্জের সদর, সিদ্ধিরগঞ্জ, ফতুল্লা, সোনারগাঁ—সব উপজেলাতেই চলছে একই ধরনের দখলবাজির প্রতিযোগিতা। রাজনৈতিক পরিচয়ে সক্রিয় কিছু ব্যক্তি অটোরিক্সা, সিএনজি, ট্রাকস্ট্যান্ড, মাছঘাট, কাঁচাবাজার—যেটাই ‘টাকার উৎস’, সেটাই ‘লক্ষ্যবস্তু’ হয়ে উঠেছে।
নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার একজন এসআই বলেন, “স্ট্যান্ড মানে শুধু গাড়ি দাঁড়ানোর জায়গা নয়—এটা এখন হয়ে গেছে অঘোষিত 'ক্যাশ কাউন্টার'। যার দখলে স্ট্যান্ড, তার হাতেই বিপুল নগদ অর্থ।”
নারায়ণগঞ্জ কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ জাহিদুর রহমান বলেন, “এই হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে দিয়েছে—আমরা কেমন অস্থির, দখলপীড়িত সময়ের মধ্যে বাস করছি। প্রশাসন যদি এখনই হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে স্ট্যান্ডগুলোই হয়ে উঠবে হত্যাকাণ্ডের নতুন যুদ্ধক্ষেত্র।”
জেলা নাগরিক আন্দোলনের আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম বলেন, “সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়হীনতা থাকলে এই ধরনের অপরাধী চক্র আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে।”
একটি স্ট্যান্ড দখল নিয়ে দুই প্রাণ ঝরে গেল। কিন্তু মূল প্রশ্ন রয়ে গেল—এরপর? কারা দায়ী? কে তদন্ত করবে? আর কে ফিরিয়ে দেবে সেই পরিবারের সন্তান, বাবা, ভাইকে? নারায়ণগঞ্জবাসী এখন সেই উত্তরের অপেক্ষায়।