নাঃগঞ্জে রিফিল হচ্ছে পুরনো সিলিন্ডার, ভয়ংকর দূর্ঘটনার আশংকা
বাংলাবাজার বার্তা ডেস্ক :
প্রকাশ: ২২:৫৬, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | আপডেট: ২৩:৩৯, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

নারায়ণগঞ্জ জেলায় কমবেশি ১ লাখ গ্রাহক এলপি গ্যাস ব্যবহার করেন। দেশের ৩৫টি কোম্পানীর মধ্যে এই জেলায় ২৭ টি কোম্পানী ব্যবসা করে। তবে অধিকাংশ এলপি গ্যাস বিক্রি হয় বড় মাঝারি মিলিয়ে ১২টি কোম্পানীর।
পুরণো ও অভিজ্ঞ গ্রাহকরা বলছেন, নারায়ণগঞ্জ জেলায় কমপক্ষে ২০ হাজার সিলিন্ডারের মেয়াদ নেই। এই সিলিন্ডারগুলোই বার বার রিফিল হয়ে গ্রাহকের বাসায় ঢুকছে। যার দরুণ আজকাল গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনা বাড়ছে। সে সাথে বাড়ছে প্রাণহানির ঘটনাও। ক্ষতি হচ্ছে জানমালের। আগামী দিনেও ভয়ংকর দূর্ঘটনার আশংকা রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মোঃ আব্দুল্লাহ আল আরেফীন জানান, এলপি গ্যাস ডিলারকে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের লাইসেন্স নিতে হয়। তাছাড়া চওড়া ও খোলামেলা জায়গায় সিলিন্ডার রাখতে হয়। ছয় বছর পর পর সিলিন্ডার বোতল পরীক্ষা করতে হবে। সেইসঙ্গে আগুন নেভানোর প্রাথমিক ব্যবস্থা থাকা চাই।
আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী'র সভাপতি ও বীরমুক্তিযোদ্ধা নূরউদ্দিন আহমদের মতে, বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ মহানগরীতে ব্যাঙের ছাতার মত এলপি গ্যাস বিক্রির দোকান চালু হয়েছে। পাড়া মহল্লায় যত্রতত্র গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করা হয়। তাদের অধিকাংশই অনুমোদন ছাড়া এ ব্যবসা করে। এসব দোকানে অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা পর্যন্ত দেখা যায় না।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, গত চার বছরে গ্যাস বিস্ফোরণ জাতীয় দূর্ঘটনায় অন্তত ১৩০ জন মারা গেছে। এলপি গ্যাসের গ্রাহকরা পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার মার্কেট থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবি তুলেছেন। তবে গ্রাহক ও দূর্ঘটনায় ভুক্তভোগীদের এই দাবির সাথে একমত হচ্ছেন না এলপি গ্যাসের ডিলাররা।
তারা বলছেন, একটি সিলিন্ডারের মেয়াদ ২০ বছর। চেক করে সমস্যা থাকলে তা সারিয়ে একটি সিলিন্ডার অনায়াসে ২০ বছর ব্যবহার করা সম্ভব। প্রথম দিকের তিনটি কোম্পানী ছাড়া বাদ বাকি কোম্পানী মার্কেটে এসেছে ২০১৫ সালের পর। সে হিসেবেও ২০ বছর পার হয়নি। তবে শুরুর দিকের (২০০৩ সাল) তিনটি কোম্পানীর সিলিন্ডারের মেয়াদ পার হয়ে গেছে।
জানাগেছে, নারায়ণগঞ্জে নিয়ম না মেনে আনাচে কানাচে বিক্রি হচ্ছে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই বিভিন্ন স্থানে রাখা হচ্ছে সিলিন্ডার বোতল। মুদি দোকান, ওষধের দোকানসহ নানা দোকানে মজুদ রাখা হচ্ছে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার। এতে যেমন ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে তেমনি বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কারণে স্মার্ট এ রান্না পদ্ধতি নিয়ে ভীতি থেকে যাচ্ছে অনেকের মনে। অকস্মাত ঘটেও যাচ্ছে প্রাণঘাতি গ্যাস বিস্ফোরণ ঘটনা। মারা যাচ্ছে স্বজন-প্রিয়জন। বোদ্ধামহল বলছেন, এসব এখনি না ঠেকালে ভবিষ্যতে আরও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
এদিকে, অনেক গ্রাহক গ্যাসের সিলিন্ডার নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন। তাদের বক্তব্য, কোনটি ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার সেটি বোঝার উপায় গ্রাহকের নেই। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবহৃত সিলিন্ডার ঘঁষামাজা করে রঙ দিয়ে নতুন বলে চালানো হচ্ছে। যেসব দোকান থেকে তারা গ্যাস কেনেন তারা এ বিষয়ে কোনো কথা শুনতে চান না বলে তাহমিনা আহমেদ শিলা, জামিল হোসেন, আব্দুস সালাম, শাহাদাত হোসেন ও সাবিনা ইয়াসমিন নামে কয়েকজন ক্রেতা জানিয়েছেন।
তারা বলেন, বাসায় যারা গ্যাস দিতে যান তাদের কাছে সিলিন্ডার নিয়ে কথা বললে দোকানে গিয়ে মালিককে বলতে বলেন। দোকান মালিক বলে দেয় কোনো অসুবিধা নাই। এ কারণে বিষয়টি আর বেশিদূর এগোয় না। কারণ ক্রেতারা গ্যাস শেষ হলে যার যার নির্ধারিত দোকানে ফোন করে সিলিন্ডার আনেন। ফলে, তাদের আর দোকানে যাওয়া হয় না।
মহল্লা পর্যায়ের খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, একটি গ্যাস সিলিন্ডারের মেয়াদ ১০ বছর। অথচ ডিলাররা আরেক কাঠি এগিয়ে বলছে কিছু শর্ত সাপেক্ষে একটি সিলিন্ডারের মেয়াদ ২০ বছর। তবে অভিজ্ঞদের মতে, ১০ বছর ব্যবহারের পর ওই সিলিন্ডার নানা কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। এ কারণে ১০ বছর পর কোনো কোনো কোম্পানি ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার বাজার থেকে তুলে নেয়ার কথা। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ জেলায় তা কখনোই হয়নি।
কোম্পানী সিলিন্ডার বদলে দিবে সেক্ষেত্রে গ্রাহককে অতিরিক্ত গুণতে হবে ৪০০ টাকা। ৪০০ টাকাসহ কোনো দোকানির কাছে পুরানো সিলিন্ডার জমা দিলে তিনি স্থানীয় ডিলারের কাছে ওই টাকাসহ জমা দেবেন। ডিলার পাঠাবেন কোম্পানীতে। সেখান থেকে আসবে নতুন সিলিন্ডার।
তার মানে নতুন সিলিন্ডার পাওয়া কিছুটা হলেও সময় সাপেক্ষ। ওই সময় পর্যন্ত গ্রাহক বিকল্প কোনো সুবিধা পাবেন না। ফলে, নিজ দায়িত্বে বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করে নিতে হবে তাকে। তিনি যদি গ্যাস ব্যবহার করতে চান তাহলে তাকে আরেকটি সিলিন্ডার কিনতে হবে।
বাংলাদেশ এলপি গ্যাস ব্যবসায়ী সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান এর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, নারায়ণগঞ্জ জেলায় ১ লাখের মতো গ্রাহক এলপি গ্যাস ব্যবহার করেন। এরমধ্যে ৬০ হাজার গ্রাাহক নিয়মিত ব্যবহার করেন এলপিজি।
২৫ হাজার গ্রাহক তিন-চার মাস পরপর কেনেন। আর ১৫ হাজার গ্রাহক কখনো কখনো গ্যাস কেনেন বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। জেলায় এলপি গ্যাসের ডিলার ৩৫ জন। খুচরা বিক্রেতার সংখ্যা ৫০০ এর বেশি। একজন গ্রাহক মাসে দুইটা এলপি গ্যাস ব্যবহার করে। কিছু কমার্সিয়াল প্রতিষ্ঠান বেশি ব্যবহার করে। জেলায় সকল উপজেলা মিলিয়ে ১ লাখ ৫৫ হাজার এলপি গ্যাস বিক্রি হয়।
শহরের একাধিক গ্যাসের দোকানে কর্মরতদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, দেশে ৩৫ টির মতো কোম্পানি আছে। নারায়ণগঞ্জের বাইরে ২৭ টি কোম্পানী গ্যাস বিক্রি করে থাকে। তবে নারায়ণগঞ্জের বাজারে ১২ টি কোম্পানির গ্যাস পাওয়া যায়। ২৭ টি কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে পুরানো তিনটি। এই তিনটি কোম্পানি হচ্ছে, বসুন্ধরা, যমুনা ও ওমেরা।
সালাউদ্দিন নামে একজন গ্রাহক বলেন, পুরানো সিলিন্ডার বদলাতে তিনি একবার দোকানে গিয়েছিলেন। কিন্তু যে প্রক্রিয়ার কথা বলা হয় তাতে আর সামনে এগোননি। শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘নতুন সিলিন্ডার কোম্পানী থেকে আসে তাহলে সেটি সময় সাপেক্ষ। তাছাড়া, কতদিন পর পাওয়া যাবে তাও নির্দিষ্ট করে বলা হয় না। ফলে, সিলিন্ডার না থাকলে খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। এই ঝুঁকি কে নেবে।
সালাউদ্দিনের সাথে সুর মেলান আরও কয়েকজন গ্রাহক, যারা রান্নাবান্নায় সম্পূর্ণ গ্যাসের উপর নির্ভরশীল। এসব গ্রাহকের বক্তব্য, ‘মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি সহজ করতে হবে। পুরানো সিলিন্ডার জমা দিয়ে দোকান থেকে যাতে সরাসরি নতুন সিলিন্ডার পাওয়া যায় সেই ব্যবস্থা করলে অধিকাংশ গ্রাহক ঝুঁকিমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করবেন।’
ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ জানায়, নিয়ম অনুযায়ী পাঁচ/ছয় বছর পর পর সিলিন্ডার পরীক্ষার করতে হয়। খরচের ভয় ও ঝামেলা মনে করে অনেক ব্যবসায়ী তা করেন না।
জানা গেছে, এলপিজি গ্যাসের ডিলাররা অনুমোদন নিয়ে শো-রুম করলেও গোডাউনের বেলায় নীয়মনীতি মানেন না। আবার তাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে যারা খুচরা বিক্রি করে তাদের অনুমোদন আছে কি-না সে খোঁজ নেয়ারও জরুরি মনে করেন না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এলাকার মুদি দোকান, মুরগির দোকান, ওষুধের দোকান, হাড়ি-পাতিল বিক্রির দোকানসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এলপিজি গ্যাস বিক্রি হচ্ছে।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ মহানগরীর ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড ও কালিরবাজার এলাকার কয়েকজন গ্যাস ব্যবসায়ী ও সিরাজউদ্দোলাহ সড়কের বসুন্ধরা ও টোটাল এলপি গ্যাস ডিলার মোঃ জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘একটি গ্যাস সিলিন্ডার ২০ বছর ধরে ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়। এরপর নানা কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তবে, গ্রাহক চাইলে কোম্পানি শর্ত সাপেক্ষে পরিবর্তন করে দিচ্ছে।
এ অবস্থা পুরানো দু’একটি কোম্পানির ক্ষেত্রে। তাছাড়া, অধিকাংশ কোম্পানিতো নতুন। তাদের সিলিন্ডার নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সব মিলিয়ে খুচরা ব্যবসায়ীরা ভালো নেই। অসম প্রতিযোগিতার কারণে আজ এই অবস্থা। মহল্লা পর্যায়ের খুচরা বিক্রেতারা টেকনিক্যাল বিষয়গুলো জানেনা বলেই সিলিন্ডারে সমস্যা হতে পারে।