ত্বকী হত্যা ও বিচারহীনতার ১৪৬ মাস

সবার একটাই প্রশ্ন—চৌদ্দ বছর পরও কেন বিচার হয় না?

বাংলাবাজার বার্তা ডেস্ক :

প্রকাশ: ০১:১৮, ১১ মে ২০২৫

সবার একটাই প্রশ্ন—চৌদ্দ বছর পরও কেন বিচার হয় না?

নারায়ণগঞ্জ, ৮ মে। বিকেলের আলো তখনো পুরোপুরি ম্লান হয়নি। শহীদ মিনারের প্রাঙ্গণে নিভু নিভু আলো—মোমবাতির ফ্লিকারে মানুষ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। কারো চোখে ক্রোধ, কারো চোখে শোক, আর সবার চোখে একটাই প্রশ্ন—চৌদ্দ বছর পরও কেন বিচার হয় না?

তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী—নারায়ণগঞ্জ শহরের এক প্রতিভাবান তরুণ, এক সম্ভাবনার নাম। যে ছেলেটি গণিতের ফর্মুলার মতো সোজাসাপটা, আর চিন্তায় ছিলো দার্শনিকের গভীরতা, সে কীভাবে একটি অপরাধপ্রবণ, ক্ষমতালোলুপ শহরের নির্মমতার শিকার হয়ে পড়ল—এ প্রশ্ন আমাদের প্রতিটি নীরবতার ভিতরে ধ্বনিত হয়।

রফিউর রাব্বি, একজন পিতা নন শুধু—একজন প্রত্যয়ে বিশ্বাসী মানুষ। তাঁর কণ্ঠে ১৪৬ মাসের জমাট কষ্ট, কেবলই ব্যক্তিগত নয়; সামাজিক প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, “শামীম ওসমানের মতো গডফাদারদের রক্ষা করতেই শেখ হাসিনার সরকার ত্বকী হত্যার বিচার বন্ধ রেখেছে।” এই কথাগুলো শুধু ক্ষুব্ধ কোনো বাবার অভিমত নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিচারহীনতার কালচিত্র।

এডভোকেট মাহাবুবুর রহমান মাসুম প্রশ্ন তোলেন—এখন তো সরকার বদলেছে না, তাহলে কিসের অভ্যন্তরীণ বাঁধা? র‌্যাব কী এখনো তাদের নখদন্তহীন? নাকি গডফাদাররা এখনো রাষ্ট্রযন্ত্রের সুতো টেনে চলেছে? মাসুমের দাবিতে ছিলো সাহস: “যদি না পারেন, তবে পদত্যাগ করুন। বিচার আদায় করেই ছাড়বো।”

নারায়ণগঞ্জ শহর, এক সময়ের জাহাজ, পাট আর মসলার বন্দর, এখন পরিচিত গডফাদার, টেন্ডারবাজ আর চাঁদাবাজদের শহর হিসেবে। ত্বকী যেন সেই শহরের বিবেক, যাকে হত্যা করে শহর নিজেই নিঃশ্বাস নিচ্ছে গিলে ফেলা গন্ধরাজের ঘ্রাণে।

অন্য বক্তাদের বক্তব্যেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে এক চিরায়ত সত্য—সত্যের পক্ষে দাঁড়ালে শহর তোমার পাশে থাকবে না, কিন্তু ইতিহাস থাকবে। ১৪৬ মাস ধরে আলোক প্রজ্বালন, প্রতিবাদ, পোস্টার, প্ল্যাকার্ড—সবই যেন প্রতিটি অন্ধকার রাতের বিরুদ্ধে নিঃশব্দ যুদ্ধ।

ত্বকীর লাশ মিলেছিল শীতলক্ষ্যার কুমুদিনী খালে, অথচ আজ পর্যন্ত তার খুনিরা বুক ফুলিয়ে ঘোরে—এটা রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ব্যর্থতা। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার পালাবদলে শুধু মুখোশ বদলায়, কিন্তু গডফাদারদের ছায়া থেকে মুক্তি মেলে না।

এখন প্রশ্ন—রাষ্ট্র কি চায় না বিচার হোক? নাকি রাষ্ট্র নিজেই কোনো অপরাধের শরিক? ত্বকী হত্যার বিচার কেবল এক পরিবারের চাওয়া নয়—এটা আমাদের সমষ্টিগত নৈতিক পরীক্ষার নাম। এই পরীক্ষায় আমরা যতবার ব্যর্থ হচ্ছি, ততবার হারিয়ে ফেলছি নতুন ত্বকীদের ভবিষ্যৎ।

এই প্রতিবেদন শেষ করি রাব্বি সাহেবের কথায়—“আমরা বিচার চাইবোই। চাইবো না শুধু, আদায় করবো।” প্রশ্ন রয়ে গেলো—আলো জ্বলে উঠবে কবে, রাষ্ট্র কি সেই আলোয় মুখ দেখাবে?

সম্পর্কিত বিষয়:

আরও পড়ুন