নয়ামাটি এখন ব্যবসায়ীদের দখলে, বাঁশ-লাঠি মিছিল সাহসের প্রতীক
‘বদু ভাই যেন আমাদের মেয়র’ : ব্যবসায়ী সমাজ
বাংলাবাজার বার্তা ডেস্ক :
প্রকাশ: ১২:৪৯, ২৬ মে ২০২৫ | আপডেট: ২৩:১৪, ২৬ মে ২০২৫

নারায়ণগঞ্জ শহর অনেক কিছু দেখেছে। রাজনৈতিক সংঘর্ষ, গার্মেন্ট শ্রমিকদের বিক্ষোভ, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ—তবে নয়ামাটিতে যা ঘটছে, তা একটু অন্যরকম। এখানে কোনও দলীয় পতাকা নেই, নেই কোনও জনপ্রতিনিধির নেতৃত্ব। এখানে লাঠি হাতে রাস্তায় নেমেছে ব্যবসায়ীরা। মুখে শ্লোগান নয়, বরং চোখেমুখে দৃঢ়তা। "এই ব্যবসা আমাদের জীবন, এই পাড়া আমাদের ঘর।" এই এক অঘোষিত স্লোগান বুকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে হোসিয়ারী ব্যবসায়ী সমাজ।
গত সপ্তাহে নয়ামাটিতে হঠাৎ করেই এক সন্ধ্যায় দেখা যায়, গলির মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন পঞ্চাশজনেরও বেশি হোসিয়ারী ব্যবসায়ী—হাতে বাঁশের লাঠি, মাথায় গামছা বাঁধা। গুজব উঠেছিল, বাইরের কিছু চাঁদাবাজ ও বহিরাগত মাদকসেবী গোষ্ঠী জড়ো হচ্ছে এলাকা দখলের জন্য। প্রশাসনের দিকে চেয়ে না থেকে নিজেরাই মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নেয় হোসিয়ারী সমিতি।
এ কর্মসূচির নেপথ্যে রয়েছেন হোসিয়ারী সমিতির প্রেসিডেন্ট বদিউজ্জামান বদু। সদ্য নির্বাচিত হলেও তিনি বুঝে গেছেন, পুরোনো কায়দায় চললে চলবে না। ব্যবসা বাঁচাতে হলে জায়গাটা আগে নিরাপদ করতে হবে। 'ব্যবসা নয়, এটা অস্তিত্বের লড়াই'। তিনি বলেন, "প্রতিদিন সন্ধ্যার পর এলাকার দোকান বন্ধ হয়, কিন্তু কিছু ছেলে মাদক নিয়ে বসে পড়ে গলির মুখে। আমরা কতদিন চেয়ে চেয়ে দেখবো? পুলিশ আসে, যায়, কিন্তু ভয়টা থেকেই যায়। এবার আমরা নিজেরাই দাঁড়িয়েছি—বলে দিয়েছি, নয়ামাটি এখন ব্যবসায়ীদের দখলে।"
এই বক্তব্য শোনার পর নয়ামাটিরই আরেক প্রবীণ ব্যবসায়ী মনিরুজ্জামান বললেন, "এই প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট দেখে মনে হলো উনি সত্যিই নেতা। বদু ভাই মাঠে নামলেন বলেই আমরা সাহস পেলাম।" একটা সময় ছিল, নয়ামাটিতে সন্ধ্যার পর দোকান খুলে রাখার সাহস করতো না কেউ মাদকসেবী, চাঁদাবাজ আর কিছু স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীর মিশেলে গড়ে উঠেছিল এক ধরণের সন্ত্রাসী নিয়ন্ত্রণ। কিছুই চোখে পড়তো না প্রশাসনের। কিন্তু ব্যবসায়ীরা জানে, রাতে কাজ না হলে এই ব্যবসা চলে না। হোসিয়ারী মানেই রাত ৯-১০টা পর্যন্ত কাজ। এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ চালানো যায় না।
তাই বাঁশের লাঠি ছিল প্রতীক, সাহসের প্রতীক। একটা সাহসী উদ্যোগের সামাজিক প্রতিধ্বনি নয়ামাটির এই কর্মসূচীর ছবি ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কেউ লিখেছেন—"ব্যবসায়ীরা যখন রক্ষক হন, তখনই সমাজ জাগে।" কেউ লিখেছেন—"পুলিশ না থাকলেও সাহসীরা আছে।" নারায়ণগঞ্জ মহানগরীতে এই কর্মসূচী একপ্রকার 'পপুলার মুভমেন্ট'-এ পরিণত হয়েছে। শহরের অন্য ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোও ভাবছে নিজেদের এলাকার নিরাপত্তা নিজে গড়ে তোলার কথা।
প্রশাসনের ভূমিকা: প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যেখানে প্রশাসন নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, সেখানে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের এই আত্মরক্ষামূলক উদ্যোগ কেবল সাহসের নয়, বরং একটি ব্যর্থ নীতির প্রতিচ্ছবিও। প্রশ্ন উঠছে—কেন প্রশাসন এই পরিস্থিতিতে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি? কেন স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ি শুধু টহল দিয়ে ফিরে যায়?
এই বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, "আমরা নিয়মিত টহল দিই। তবে এলাকাবাসীর সহায়তা ছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন। ব্যবসায়ীরা যদি সচেতন হয়, তবেই স্থায়ী সমাধান সম্ভব।"
বদিউজ্জামান বদু: একজন 'আনঅফিশিয়াল মেয়র'? এতদিন তাঁকে শুধু হোসিয়ারী ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে দেখা হতো। এখন অনেকেই বলছেন, "বদু ভাই যেন আমাদের মেয়র। প্রশাসন যা পারেনি, উনি তা করে দেখিয়েছেন।" তার পদক্ষেপ রাজনীতির বাইরের নেতৃত্ব তৈরির এক নজির হয়ে থাকলো। তিনি প্রমাণ করলেন—স্থানীয় নেতৃত্ব আসলে কতটা শক্তিশালী হতে পারে, যদি সে সাহসিকতা ও নৈতিক অবস্থান ধরে রাখতে পারে।
নয়ামাটির লাঠি-কর্মসূচী কেবল একটি এলাকার প্রতিবাদ নয়, এটি এক ধরণের সামাজিক পুনর্জাগরণ। বদিউজ্জামান বদুর নেতৃত্বে হোসিয়ারী ব্যবসায়ীরা যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, তা প্রশাসন ও বৃহৎ সমাজ—উভয়ের জন্যই এক বার্তা। নিরাপত্তা যদি না পাওয়া যায়, মানুষ নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেই। বাঁশের লাঠি কেবল একটি প্রতীক—এটি সাহস, প্রতিরোধ ও সম্মিলিত চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছে নয়ামাটির বুকে।