প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ভুয়া ওয়েবসাইট

নাঃগঞ্জে উচ্চশিক্ষার নামে ঠগবাজি !

বাংলাবাজার বার্তা ডেস্ক :

প্রকাশ: ০০:৩৪, ১৯ মে ২০২৫

নাঃগঞ্জে উচ্চশিক্ষার নামে ঠগবাজি !

একটি সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র ‘নারায়ণগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ এর নামে ভুয়া ওয়েবসাইট বানিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রতারনা শুরু করেছে। উক্ত ভর্তি বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে সতর্ক করেছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

গতকাল রোববার (১৮ মে) ইউজিসির পরিচালক ড. শামসুল আরেফিন জানান, ২০২৩ সালে অনুমোদনপ্রাপ্ত নারায়ণগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগসহ প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি।

অথচ একটি প্রতারক চক্র বিশ্ববিদ্যালয়টির নামে একটি ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করেছে। ওয়েবসাইটে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে শিক্ষার্থী ভর্তির অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে, যা সম্প্রতি ইউজিসির নজরে এসেছে।

ইউজিসির সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয়টির নামে প্রতারক চক্র পরিচালিত ওয়েবসাইট পর্যালোচনা করেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে ভারতের কলকাতার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস হিসেবে গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও অবকাঠামোর ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।

ভুয়া তথ্য বিভ্রান্ত হয়ে কোনো প্রকার আর্থিক লেনদেন কিংবা ভর্তি সংক্রান্ত পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সতর্ক করেছে ইউজিসি।

একটা সময় ছিল যখন উচ্চশিক্ষা মানেই ছিল গুরুজনদের চোখে পানি, মায়ের মাথায় সাদা ওড়না, বাবার মুখে চাপা গর্ব। আর এখন? এখন গাজীপুরের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবিতে ঠাসা ‘নারায়ণগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ নামের একটা ওয়েবসাইট দেখে ছাত্ররা ভর্তি হতে চায়, আর প্রতারক চক্র বিকাশে ফি নিয়ে গা ঢাকা দেয়।

ঘটনাটা হালকা করে দেখার নয়। কারণ এটা শুধু প্রতারণা নয়,রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনাকে পুঁজি করে শিক্ষার নামে নোংরা এক ব্যবসা। ইউজিসি (বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) স্বয়ং বলছে—এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রমই শুরু হয়নি, অথচ ওয়েবসাইটে ইতিমধ্যে ছাত্র ভর্তির ডাক! এমন সাহস কেবল তখনই আসে, যখন ‘প্রতারণা’ একটা কারিগরি শিল্প হয়ে ওঠে।

এই ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ভারতের এক প্রফেসরের ছবি কেটে এনে বসানো হয়েছে ‘ভিসি’ হিসেবে। ক্যাম্পাসের নামের জায়গায় দেখা যাচ্ছে গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যান্ডস্কেপ। এমন ফটোশপ-ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম দেয়া উচিত ছিল, “আল্ট্রা এডিটিং ইউনিভার্সিটি”!

প্রশ্নটা অনেকটা সোজা, উত্তরটা ঘোরালো। এত নিখুঁতভাবে তৈরি সাইট, এত বিশ্বাসযোগ্য ‘ভর্তি বিজ্ঞপ্তি’, বিকাশ নাম্বারসহ ডিজিটাল ফাঁদ এসব কাজ সাধারণ প্রতারকের কর্ম নয়। এখানে প্রযুক্তি জানা লোক, একজন ‘লিগ্যাল জানে এমন’ সদস্য এবং সম্ভবত কোনো ভবিষ্যৎ রাজনীতিক থাকাও বিচিত্র নয়।

এ ধরনের অপারেশনে ‘লোকাল পলিটিক্যাল পৃষ্ঠপোষকতা’ থাকে বলেই তারা নিশ্চিন্তে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামেও টাকা তোলে, এবং কেউ কিছু বলে না—ততক্ষণ, যতক্ষণ না ইউজিসির মতো প্রতিষ্ঠানের চোখে পড়ে।

‘নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের খসড়া আইন’ নিয়ে সরকারের কমিটি বসে, কাগজে কলমে আলোচনা হয়, সময় নেয়। আর প্রতারক চক্র ওয়েবসাইট খুলে ভর্তি নিচ্ছে! একপাশে আমলাতান্ত্রিক ধীর গতি, অন্যপাশে প্রতারণার ডিজিটাল চৌকসতা।

রাষ্ট্র এখানে দর্শক। ছাত্র ও অভিভাবক এখানে টার্গেট মার্কেট। যখন ছাত্র ভর্তি হয় একটা ভুয়া প্রতিষ্ঠানে, তখন শুধু টাকা নয়—ভবিষ্যতের স্বপ্নটাও মারা যায়। পাস করা যায় না, সার্টিফিকেট পাওয়া যায় না, সরকার স্বীকৃতি দেয় না—তখন যে মানসিক ধাক্কাটা লাগে, সেটা কোন আইনে বিচার হবে?

ইউজিসি সতর্ক করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ভুয়া সাইট বন্ধে কয়টা মামলা হয়েছে? ক’জন প্রতারক ধরা পড়েছে? যে দেশে বিশ্ববিদ্যালয় বানানো যায় একটা ফ্রি ওয়েবসাইটে, যে দেশে ভিসি বানানো যায় গুগল থেকে ছবি তুলে, সে দেশে ‘ডিগ্রি’ মানে কেবল কাগজ না একটা তামাশা।

প্রতারণা শুধু অর্থনৈতিক না, এটা একটা জাতির মেরুদণ্ডে চুরি। আর যদি এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে আগামী প্রজন্ম শুধু ভুয়া সার্টিফিকেট না, ভুয়া ভবিষ্যতও হাতে পাবে। নাম শুনলেই বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ইউজিসি তালিকা দেখে নিশ্চিত হন। শিক্ষা যদি পণ্য হয়, প্রতারণা তার প্যাকেজিং। আর আমরা, এই রাষ্ট্র এখনো দর্শক।

আরও পড়ুন