রাষ্ট্র বনাম জনগণ: আইভীর গ্রেপ্তার এবং -----------

ইমতিয়াজ আহমেদ

প্রকাশ: ২৩:৪৫, ৯ মে ২০২৫

রাষ্ট্র বনাম জনগণ: আইভীর গ্রেপ্তার এবং -----------

নারায়ণগঞ্জের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর গ্রেপ্তার আমাদের সামনে একটি পুরোনো প্রশ্ন পুনরায় হাজির করেছে—এই রাষ্ট্র কার জন্য এবং কাদের শাসনে পরিচালিত?

একজন জনপ্রতিনিধি, যিনি বারবার নির্বাচিত হয়েছেন জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে, যিনি রাষ্ট্রীয় দখলদারি, মাফিয়াচক্র ও সুবিধাবাদী রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছেন—তাকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে গ্রেপ্তার করা হলো। কী ছিলো তাঁর অপরাধ? কী এমন অপরাধমূলক কাজ তিনি করেছিলেন, যার জন্য রাতের অন্ধকারে রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগ প্রয়োজন হলো?

এই প্রশ্নগুলো কেবল একটি ব্যক্তিকে ঘিরে নয়, বরং আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোর অভ্যন্তরীণ দুর্বৃত্তায়নের খোলস উন্মোচন করে।

সাংবিধানিক বিচারে এই গ্রেপ্তারের অবস্থান কোথায়? বাংলাদেশের সংবিধান, ১৯৭২, তার ১১ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলে—“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং therein shall be guaranteed fundamental human rights and freedoms and respect for the dignity and worth of the human person.”

কিন্তু আইভীর ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এমন এক অভিযোগে—যা এখনো পূর্ণ তদন্তাধীন, কোনো আদালতে যথাযথ বিচার হয়নি, এবং যা জনতার মধ্যে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সাংবিধানিকভাবে ‘প্রেসাম্পশন অফ ইনোসেন্স’ বা 'অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ ধরে নেওয়ার অধিকার’ ভঙ্গ করা হয়েছে কিনা, সেই প্রশ্ন আজ স্বাভাবিক।

সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ বলছে, “প্রত্যেক নাগরিক আইনানুযায়ী সুরক্ষা ভোগ করিবেন এবং আইনের আশ্রয়লাভে সমান অধিকারী হইবেন।”

কিন্তু এই রাষ্ট্রে ‘আইভী’ নামধারী কোনো ব্যক্তি যদি ক্ষমতাকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত না হন, তবে তার জন্য আইনও যেন আলাদা হয়।

২০১১ ও ২০১৬ সালের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ডা. আইভী যে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, তা বাংলাদেশের দুর্বল নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্যেও বিরল। ২০১৬ সালে তিনি প্রায় ১.৭৫ লক্ষ ভোটে জয়লাভ করেছিলেন, যা ছিল তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার নজির।

আজ সেই জনপ্রিয়তাই তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। কারণ, এই রাষ্ট্রে গণভিত্তির চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বারবার প্রমাণ করেছে, তারা শাসকের স্বার্থে কাজ করতে প্রস্তুত, জনগণের পক্ষে নয়।

ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী একজন রাজনীতিক হিসেবে প্রমাণ করেছেন—দলের বাহিরেও জনপ্রিয়তা অর্জন সম্ভব, এবং সেটি গণমুখী কাজে। এই ধারা রাষ্ট্রের জন্য অস্বস্তিকর। কেননা, একটি সেন্ট্রালাইজড, দলনির্ভর, সুবিধাবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তির বিবেকনির্ভরতা সবসময়ই হুমকি। তাই তাঁকে থামাতে হয়েছে।

গ্রেপ্তারের পর তার বাড়ির সামনে জনতার জড়ো হওয়া, মসজিদের মাইকে ঘোষণা—এগুলো রাষ্ট্রকে আতঙ্কগ্রস্ত করে। কারণ এগুলো সেই প্রশ্নের জন্ম দেয়, যা রাষ্ট্র কখনো চায় না—“কারা শাসক? আর কাদের হয়ে তারা শাসন করছে?”

ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর গ্রেপ্তার একটি দুঃখজনক নজির। তবে তা একান্ত ব্যক্তি বা দলীয় রাজনীতির ব্যাপার নয়—এটি আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোর গভীর দুর্বলতা ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের প্রমাণ।

গণতন্ত্রের নামে চলা এই ব্যবস্থাটি এখনো যদি নিজেকে গণতান্ত্রিক বলতে চায়, তবে তাকে একবার আয়নার সামনে দাঁড়াতে হবে।

কারণ একটি রাষ্ট্র তখনই গণতান্ত্রিক হয়, যখন সে বিরোধী কণ্ঠকে ভয় পায় না, বরং শ্রদ্ধা করে। আর রাষ্ট্র যখন নিজের জনগণকে ভয় পেতে শুরু করে, তখন সে নিজেই নিজের অবসান ডেকে আনে।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

লেখক : সিনিয়র গণমাধ্যম কর্মী

আরও পড়ুন