ডাঃ আইভীকে কাশিমপুর কারাগারে প্রেরণ

বাংলাবাজার বার্তা ডেস্ক :

প্রকাশ: ২৩:৪১, ৯ মে ২০২৫

ডাঃ আইভীকে কাশিমপুর কারাগারে প্রেরণ

নগরমাতা ডাঃ সেলিনা হায়াৎ আইভী সারাজীবন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। খুন, হত্যা, গুম ও নিজদলের জনবিরোধী ভূমিকা তিনি কখনোই সমর্থন করতেন না। যার দরুন বড় ভাই খ্যাত সাবেক এমপি শামীম ওসমানের সাথে তাঁর কোনদিনই বনিবনা হয়নি। মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ডাঃ আইভীর দরজা সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল। তিনি ছিলেন ন্যায়ের প্রতীক।

তাঁর গ্রেফতারে নারায়ণগঞ্জের আপামর জনসাধারণের মনে ক্ষোভ জমেছে।

জনতার মনে বিরাট প্রশ্ন-কেনো ডাঃ আইভীর মত একজন সর্বজনবিদিত জনপ্রতিনিধিকে হঠাৎ করেই গ্রেফতার করা হলো ? মামলাতো আগেই হয়েছে। তিনিতো (ডাঃ আইভী) পালিয়ে যাননি। নাসিক এর মেয়র পদ থেকে প্রত্যাহার করার থেকে তিনি দেওভোগে পৈতৃক বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন।

যেখানে নারায়ণগঞ্জের বাঘা বাঘা আওয়ামীলীগ নেতা দেশ ছেড়েছেন-সেখানে ডাঃ আইভী নির্বিঘ্নে শহরে বিচরণ করতেন। এমন জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধিকে কেনো গ্রেফতার করা হলো ? প্রশ্নের উত্তর মিলছেনা।

জানাগেছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। প্রায় ৬ ঘণ্টা চেষ্টার পর  গতকাল শুক্রবার (৯ মে) ভোর পৌনে ৬টার দিকে জেলা শহরের দেওভোগ এলাকায় তাঁর নিজ বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এরপর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে ঢাকার কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। শুক্রবার (৯ মে) সকাল ১০টায় সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাঈনুদ্দিন কাদিরের আদালতে হাজির করা হয় তাকে। এরপর সিদ্ধিরগঞ্জে পোশাক শ্রমিক মিনারুল হত্যা মামলায় শুনানী শেষে এ নির্দেশ দেন আদালত।

বিষয়টি নিশ্চিত করে আদালত পুলিশের পরিদর্শক কাইউম খান বলেন, স্পেশাল র্কোটে তাকে তোলার পর আদালত তাকে কাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। তবে আইভী একজন ভিআইপি আসামী। তাকে নারায়ণগঞ্জ কারা কতৃপক্ষ ঢাকার কাশিমপুর মহিলা কারাগারে প্রেরণ করেছেন। আজ আদালতে তার বিরুদ্ধে পুলিশ রিমান্ডের আবেদন করেনি পুলিশ, জামিনও চাওয়া হয়নি।’

এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তারেক আল মেহেদী বলেন, ‘আইভীর বিরুদ্ধে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও হামলার ঘটনায় অন্তত পাঁচটি মামলার আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে মিনারুল হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।’

প্রায় ৬ ঘণ্টা চেষ্টার পর  গতকাল শুক্রবার (৯ মে) ভোর পৌনে ৬টার দিকে জেলা শহরের দেওভোগ এলাকায় তাঁর নিজ বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় সেখানে তাঁর বিপুলসংখ্যক সমর্থক অবস্থান করছিলেন। গাড়িবহর নিয়ে পুলিশও ছিল সতর্ক অবস্থানে। এ সময়ও আইভীর বাড়ির সামনে বিপুলসংখ্যক সমর্থক অবস্থান করছিলেন।

পুলিশের ভ্যানে ওঠার আগে আইভী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি জানি না আমাকে কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? আমার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে জানিয়েছে প্রশাসন, কিন্তু আমাকে দেখাতে পারেনি। আমি ২১ বছর সকল কিছুর উর্ধ্বে থেকে নারায়ণগঞ্জবাসীকে সেবা দিয়েছি। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলা যদি অপরাধ হয়, তাহলে আমি সেই অপরাধে অপরাধী হতে চাই।’

আইভী বলেন, ‘আমি কি কোনো জুলুমবাজ? আমি কি হত্যা করেছি? আমি কি চাঁদাবাজি করেছি? নারায়ণগঞ্জ শহরে আমি কোনো দিন কোনো বিরোধী দলকে আঘাত করেছি—এমন রেকর্ড আছে? তাহলে কিসের জন্য, কোন ষড়যন্ত্রের কারণে, কার স্বার্থে আমাকে গ্রেপ্তার করা হলো? আমিও প্রশাসনের কাছে জানতে চাই। বর্তমান যারা সরকারে আছেন, তারা সাম্যের কথা বলেছেন, বৈষম্যের বিরুদ্ধে আপনারা আন্দোলন করেছেন, সরকারকে হটিয়ে নতুন সরকারে এসেছেন—তাহলে কী এই বৈষম্য? তাহলে সৎ রাজনীতি, সততার কী মূল্যায়ন? আমি তো বাড়িতেই ছিলাম, পালাইনি। তাহলে এভাবে আমাকে গ্রেপ্তার করতে হলো কেন? সেই জবাব জনগণের কাছে চাই, জনগণই দিবে। ইনশাল্লাহ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’

 এর আগে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে আইভীকে গ্রেপ্তারের জন্য তাঁর বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। এ খবর শুনে চারদিক থেকে হাজার হাজার এলাকাবাসী তার বাড়ির সামনে এসে জড়ো হয়।

রাতে তাদের উদ্দেশ্যে আইভী বলেন, তাদের (পুলিশ) বলবা আমি দিনের বেলা ছাড়া যাবো না। আমাকে আটক করতে হলে দিনের বেলা আসতে হবে। দিনের বেলা আমাকে নিতে হবে। এরপর উত্তেজিত জনতা বাড়ির প্রধান ফটক অবরোধ করে তার মুক্তির দাবিতে নানা স্লোগান দেয় এবং বাড়ির প্রবেশ পথের দুই রাস্তায় বাঁশ, ঠেলাগাড়ি ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখে।

এ সময় শত শত নারী পুরুষ ‘দল যার যার, আইভী আপা সবার’, ‘আইভী আপার কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’ স্লোগান দিতে থাকেন ।  এছাড়া আশেপাশের এলাকার মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে স্থানীয়দের রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানায়। একপর্যায়ে আশেপাশের ৪টি সড়কও তারা অবরুদ্ধ করে রাখে।

পরে রাত ৩টার দিকে পুলিশের তিন সদস্যের একটি টিম আইভীর বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। এ সময় আইভী তাদের কাছে রাতের বেলা গ্রেপ্তার করার বিষয়ে অস্বীকৃতি জানায়। সকালে তাকে দিনের আলোতে গ্রেপ্তার করার কথা জানায়। সেই অনুযায়ী তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তার করার সময় সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেছেন, আমি তো বাড়িতেই ছিলাম, আমি তো পালাইনি। তাহলে এইভাবে আমাকে গ্রেপ্তার করতে হলো কেন?

তিনি আরও বলেন, আমি কী জুলুমবাজ, আমি কী হত্যা করেছি, আমি কী চাঁদাবাজি করেছি, আমার এমন কোন রেকর্ড আছে নারায়ণগঞ্জ শহরে কোন বিরোধী দলকে আঘাত করেছি, তাহলে কীসের জন্য কী কারণে, কোন ষড়যন্ত্রের কারণে কার স্বার্থে আমাকে গ্রেপ্তার করা হলো।

তিনি বলেন, আপনারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন, নতুন সরকার এসেছে। আমি কোনো অপরাধ করিনি তাহলে কেন আমাকে গ্রেপ্তার, জানতে চাই সরকারের কাছে।

জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু বলায় যদি আমার শাস্তি হয় তাহলে আমি তা মাথা পেতে নেব। আমি কোনো অন্যায় করিনি, চাঁদাবাজি করিনি, হত্যা করিনি। যখন নারায়ণগঞ্জের একটা মানুষও কথা বলতো না প্রতিবাদ করতো না তখন ত্বকী হত্যার প্রতিবাদসহ সব প্রতিবাদ আমি করেছি। আমি আপনাদের সেবা দিয়েছি।

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও অপারেশন) তারেক আল মেহেদি জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় হত্যা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে আইভীর বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ৪টি ও ফতুল্লা থানায় ১টি মামলা আছে। তাকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

স্থানীয়রা জানায়, গত ৫ আগস্টের পর এই প্রথম বিপুলসংখ্যক পুলিশের একটি বহর সেলিনা হায়াৎ আইভীর বাড়িতে আসে। এ সময় এলাকাবাসী পুলিশ আসার খবর পেয়ে বাড়ির চারপাশে অবস্থা নিতে শুরু করে। পরে আশপাশের মসজিদগুলো থেকে পুলিশ আসার খবর ছড়িয়ে পড়লে শতশত মানুষ এসে বাড়ির আশপাশের কয়েকটি স্থানে ব্যারিকেড দিয়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। রাত দেড়টা পর্যন্ত দেওভোগ সড়কের বিভিন্ন এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়িকে অবস্থান করতে দেখা গেছে।

এলাকাবাসী জানায়, সাবেক মেয়র আইভী স্থানীয়দের মধ্যে জনপ্রিয়। তাই স্থানীয়রা এই পুলিশি অভিযান প্রতিহত করতে সড়কে নেমেছেন।

প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন নারায়ণগঞ্জে একটি হত্যা মামলায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকে আসামি করা হয়েছে। মামলার বাদী নাজমুল হক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন গুলিতে নিহত পোশাকশ্রমিক মিনারুল ইসলামের ভাই। মামলায় ১৩২ জনের নাম উল্লেখ করে আরও ২০০-৩০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়।

সেলিনা হায়াৎ আইভী ২০০৩ সালে বিএনপি জোট সরকারের আমলে প্রথম নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে শামীম ওসমানকে লক্ষাধিক ভোটে হারিয়ে দেশের প্রথম নারী মেয়র নির্বাচিত হন তিনি।

গণঅভ্যূত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১৯ আগস্ট দেশের বাকি সিটি করপোরেশনগুলোর মতো টানা তিনবার নির্বাচিত সিটি মেয়র আইভীকেও অপসারণ করে অন্তর্বর্তী সরকার।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটলেও 'পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ' হিসেবে পরিচিত সেলিনা হায়াৎ আইভীকে এই ধরনের কোনও পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি।

আরও পড়ুন